পুলক বেরা, পূর্ব মেদিনীপুরঃ জগতের নাথ যিনি তিনিই জগন্নাথ। ভগবান বিষ্ণুর অবতার বা স্বয়ং বিষ্ণু-ই বলা হয় তাঁকে। আজ তাঁর পবিত্র স্নানযাত্রা উৎসব। যে উপলক্ষে শুধু নীলাচল নয়, মেতে উঠেছে বিশ্বের প্রতিটি কোণায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা তাঁর আপামর ভক্তকূল।
জগন্নাথ দেবের স্নানযাত্রাকে ঘিরে রয়েছে একাধিক অলৌকিক ঘটনা। স্কন্দ পুরাণ মতে, রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন একমাত্র কাঠের বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করেন জগন্নাথ দেবের। এই স্নানযাত্রাকে জগন্নাথ দেবের আবির্ভাব তিথি হিসাবে পালন করা হয়। তখন থেকেই পালিত হয় স্নানযাত্রার এই মহোৎসব।
জগতের নাথের স্নানযাত্রা ঘিরে ভক্তদের মাঝে শোরগোল । জৈষ্ঠ্য পূর্ণিমা তিথিতে স্নানযাত্রা হয় বলে একে স্নান পূর্ণিমা বা দেবস্নান পূর্ণিমা বলা হয়ে থাকে। এই পুণ্য তিথিতে ভক্তদের উদ্দীপনা চোখে পড়ার মতো। শুধুই পুরী না তমলুকের মহাপ্রভু মন্দিরে এবং রামনগরের ডেমুরিয়ার প্রায় ৩০০ বছরের প্রাচীন জগন্নাথ মন্দিরেও পালিত হচ্ছে স্নানযাত্রার উৎসব।
কথিত আছে এই পুণ্য তিথিতে রাজা ইন্দ্রদ্যুম্নকে জগন্নাথ দেব আদেশ করেন যেন ১০৮টি কলসির জলে তাঁকে স্নান করিয়ে অভিষেক করানো হয়। ভগবানের এই আদেশকে মান্যতা দিয়েই প্রতি জৈষ্ঠ্য পূর্ণিমায় ১০৮টি কলসির জলে পবিত্র স্নান করানো হয় তিন ভাইবোনকে। মহাস্নানের আগে অবধি রত্নবেদীতেই অবস্থান করেন জগন্নাথ এবং প্রথমে জগন্নাথ, তারপর বলভদ্র, শেষে সুভদ্রাকে পুষ্পাঞ্জলি দিয়ে পুজো করেন মন্দিরের সেবায়েতরা। তারপর তিন ভাই বোনকে নিয়ে যাওয়া হয় স্নানবেদীর উদ্দেশ্যে। সেখান থেকে জগন্নাথদেব সহ বলরাম ও সুভদ্রাকে সুন্দর পট্টবস্ত্র দিয়ে ঢেকে নিয়ে যাওয়া হয় স্নানমঞ্চে।
বিভিন্ন প্রান্তের পাশাপাশি পূর্ব মেদিনীপুর জেলার তমলুক ও রামনগরের প্রাচীন রথযাত্রার স্নানযাত্রায় মেতে উঠেছে ভক্তরা। সকাল থেকে পূজার্চনার মধ্য দিয়ে জগন্নাথ দেবের স্নানযাত্রা পালন করা হয়।
রামনগরের ডেমুরিয়ার প্রায় ৩০০ বছরের প্রাচীন জগন্নাথ মন্দিরে স্নানযাত্রা উৎসব মহাসমারোহে পালন করা হচ্ছে । প্রাচীন রীতি রেওয়াজ এবং ঐতিহ্য মেনে এবারও পালিত হলো স্নান যাত্রা উৎসব।
রামনগর সহ পূর্ব মেদনীপুর এলাকার মানুষের কাছে খুবই জনপ্রিয় এই রথযাত্রা। ডেমুরিয়া রথযাত্রা প্রাচীন রথযাত্রার মধ্যে একটি। শনিবার (২২ জুন) সকালে পবিত্র রীতি-নীতি মেনে স্নানযাত্রা করানো হয়।
কথিত রয়েছে, বহুদিন আগে ওড়িশার বসবাসকারী মগ্নিনারায়ণ চৌধুরী ডেমুরিয়াতে বসবাস করার জন্য আসেন। তার ইচ্ছা ছিলো ডেমুরিয়া এলাকা থেকে ভক্তদের দিয়ে পুরীর মন্দিরে রথযাত্রা দেখানো। সেই অনুসারে প্রতিবছর রথের সময় পূণ্যার্থীদের নিয়ে পুরী যেতেন ।
বহু তীর্থযাত্রী পায়ে হেঁটে ডেমুরিয়া থেকে যেতেন পুরীর রথযাত্রার দেখতে।
দীর্ঘ কয়েক বছর এরকম ভাবে চলতে থাকার পর বয়সজনিত কারণে মাঝে মাঝে অসুস্থ হয়ে পড়তেন তিনি। একসময় ভক্তদের নিয়ে পুরী যাওয়ার পথে ওড়িশার বালেশ্বরে আচমকাই অসুস্থ হয়ে পড়েন মগ্নিনারায়ণ চৌধুরী । অসুস্থ থাকাকালীন প্রভু জগন্নাথ দেব তাকে স্বপ্নাদেশ দেন তিনি যেন আর কষ্ট করে প্রতিবছর তীর্থযাত্রীদের নিয়ে পুরী না এসে বাড়ির কাছে প্রভু জগন্নাথ দেবের মূর্তি প্রতিষ্ঠা করেন।
সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে মগ্নিনারায়ণ জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রার মাটির মূর্তি করে পুজো শুরু করেন ডেমুরিয়াতে। ১৭৪৩ সাল থেকে ১৭৫২ সাল পর্যন্ত বর্গীদের থেকে জগন্নাথ,বলরাম ও সুভদ্রাকে বাঁচাতে কাছাকাছি করুণাকরণ পাহাড়ির বাড়িতে লুকিয়ে রেখেছিলেন। সেখানেই দৈনন্দিন ভোগ ও পূজা-অর্চনা করতেন তিনি ।
করুণাকরন পাহাড়ি পরবর্তী কালে চৌধুরি উপাধি নিয়ে জগন্নাথ দেবের সেবায় নিয়োজিত হন। প্রতিবছরই পুরীর রীতি মেনে জগন্নাথ ,বলরাম, সুভদ্রা তিনটি আলাদা রথে চড়ে মাসির বাড়ি যান । কয়েকশো বছর আগে জমিদার যাদবরাম রায় প্রচুর পরিমাণে সম্পত্তি দান করেন জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রার নামে। রামনগরের ডেমুরিয়া রথযাত্রা উপলক্ষে প্রতি বছর কয়েক লক্ষ ভক্তের সমাগম ঘটে এই যাত্রায়।