ভারতীয় রেল (Indian Railway) শুধু বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম রেল নেটওয়ার্ক-ই নয়, দেশের অন্যতম সর্ববৃহৎ কর্মসংস্থানের ক্ষেত্র। যেখানে যুক্ত রয়েছেন লক্ষাধিক কর্মী। অন্যদিকে, আরও কয়েক লক্ষ মানুষ রেলে নিত্য যাতায়াত করেন জীবিকা নির্বাহের জন্য। এক কথায়, ভারতীয় রেল-ই দেশের লাইফ লাইন। রেলকে ঘিরেই কোটি কোটি ভারতবাসীর স্বপ্ন দেখা শুরু হয় প্রতিদিন। কিন্তু সম্প্রতি সেই রেল-ই হয়ে উঠেছে দেশের মানুষের দুঃস্বপ্নের কারণ। একের পর এক রেল দুর্ঘটনা প্রশ্নের মুখে ফেলে দিয়েছে যাত্রী সুরক্ষাকে। নেটিজেনরা প্রশ্ন তুলেছেন, তাহলে কি মানুষের জীবনের কোনওই মূল্য নেই? প্রশ্ন উঠছে কবচ (Kavach) প্রযুক্তি নিয়ে।
আরও পড়ুনঃ কাঞ্চনজঙ্ঘা দুর্ঘটনায় আহত ছেলেদের ঘরে ফেরার অপেক্ষায় পরিবার
সবার আগে মাথায় রাখতে হবে আধুনিক ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতার পর থেকে বিভিন্ন সময়ে একাধিক পরিবর্তন ঘটেছে রেলের পরিকাঠামোয়। যাত্রী সুরক্ষার কথা মাথায় রেখে এসেছে নয়া নয়া একাধিক প্রযুক্তি। বিশেষ করে, ২০২২ সালে সম্পূর্ণ দেশীয় প্রযুক্তিতে তৈরী কবচ (Kavach) সিস্টেম চালু হওয়ার নেপথ্যে রেল দুর্ঘটনার সংখ্যা হ্রাস পাবে, এই দাবিই করা হয়েছিল রেলের তরফে। কিন্তু গত বছর ওড়িশার বালাসোরের কাছে করোমণ্ডল এক্সপ্রেসের দুর্ঘটনা এবং সম্প্রতি উত্তরবঙ্গের রাঙ্গাপানিতে শিয়ালদহগামী কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেসের দুর্ঘটনা যেন চোখে আঙুল দিয়েই দেখিয়ে দিচ্ছে ভারতীয় রেল যতই কবচ (Kavach) সিস্টেম চালু করুক না কেন, যাত্রীদের জন্য কোনও সুরক্ষাকবচ যে আসলে এখনও নেই সেটা দিনের আলোর মত পরিষ্কার। আর এখান থেকেই নানা মহলের প্রশ্ন, ভারতীয় রেলের ‘যাত্রী সুরক্ষা’ ঠিক কোন পর্যায় রয়েছে। বিশেষ করে সাম্প্রতিক দুর্ঘটনায় সার্চ ইঞ্জিনের টপে যে ‘কবচ সিস্টেম’ (Kavach), আসুন, দেখে নিই সেই কবচ সিস্টেম আসলে কী।
কবচ সিস্টেম আসলে কী?
কবচ সিস্টেম একটি সেন্সর ভিত্তিক স্বয়ংক্রিয় ট্রেন সুরক্ষা বা ট্রেন কলিশন অ্যাভয়েডেন্স সিস্টেম। একাধিক সংস্থার সহযোগিতায় যেটি রিসার্চ ডিজাইন এন্ড স্ট্যান্ডার্ড অর্গানাইজেশন সম্পূর্ণ দেশীয় প্রযুক্তিতে তৈরি করেছে। কবচ অর্থাৎ যা কিনা যেকোনও বিপদ-আপদ থেকে রক্ষা করে। এই সিস্টেম প্রাথমিকভাবে ২০১২ সালে Train Collision Avoidance System (TCAS) নামে শুরু হয়। কোনও কারণে সিগন্যাল চালকদের চোখ এড়িয়ে গেলে এবং সিগন্যাল পাসড অ্যাট ডেঞ্জার (SPAD) হলে দুর্ঘটনা এড়ানো সম্ভব কবচের (Kavach) মাধ্যমে। এই ব্যবস্থা অনুসারে যদি লোকো পাইলট জরুরি অবস্থায় ট্রেন থামাতে ব্যর্থ হন তাহলে ট্রেন স্বয়ংক্রিয়ভাবেই থেমে যাবে। এছাড়া একই লাইনে খুব কম দূরত্বে দুটি ট্রেন উঠে গেলে কবচ সিস্টেমের মাধ্যমে সেই বার্তাও চলে যাবে চালকদের কাছে। ফলে দুর্ঘটনার হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে।
কীভাবে কাজ করে কবচ সিস্টেম?
এই সিস্টেম (Kavach) পুরোপুরি সেন্সর ভিত্তিক। এর মাধ্যমে বিপদ সংক্রান্ত যে কোনও তথ্য আপডেট মেশিন ইন্টারফেস মাধ্যমে পেয়ে লোকো পাইলট সতর্ক হতে পারবেন। ট্রেন লেভেল ক্রসিং গেটের কাছে যাওয়ার মুহূর্তে স্বয়ংক্রিয়ভাবে হুইসেল বেজে উঠবে। এছাড়া ট্রেনের গতিবিধি-ও এই সিস্টেমের মাধ্যমে সর্বক্ষণ পর্যবেক্ষণ করা যাবে। সেইসঙ্গে কোনও ট্রেন যদি ওভার স্পিডিং হয় তাহলে স্বয়ংক্রিয় ব্রেকের মাধ্যমে সেটিকে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। ফলে দুটি ট্রেনের মধ্যে যদি সংঘর্ষের পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়, তবে সেটি প্রতিরোধ করা যাবে।
কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেসের দুর্ঘটনায় কবচ সিস্টেম কাজ করল না কেন?
কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেসের দুর্ঘটনার পর প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে কবচ (Kavach) ব্যবস্থা নিয়ে। আর তার জেরেই নড়েচড়ে বসেছে রেল। রেলসূত্রে খবর, ১০ হাজার কিলোমিটার লাইনের জন্য কবচ সিস্টেম চালু করার জন্য টেন্ডার ডাকা হয়েছিল কিন্তু এরমধ্যে মাত্র ৬ হাজার কিলোমিটার রেলপথেই টেন্ডার দেওয়া হয়েছে। এবং এখনও পর্যন্ত সবমিলিয়ে দেশের মাত্র ১,৫০০ কিলোমিটার রেলপথেই কবচ প্রযুক্তির ব্যবহার শুরু হয়েছে। রেলওয়ে বোর্ডের চেয়ারপার্সন এবং CEO জয়া ভার্মা জানিয়েছেন, গুয়াহাটি রুটে কবচ সিস্টেম এখনও চালু হয়নি। তবে আগামী বছরের মধ্যে আরও ৬ হাজার কিলোমিটার রেলপথে কবচ ব্যবস্থা চালু করার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে রেল। এরমধ্যে রয়েছে হাওড়া-দিল্লি রেলপথ।
এদিকে কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেসে দুর্ঘটনার নেপথ্যে আসলে ঠিক কী কারণ তা পরিষ্কার করে জানানো হয়নি রেলের তরফে। তদন্তের পরেই কারণ জানা সম্ভব বলে জানাচ্ছে তারা। আসলে ফিবছর রেল দুর্ঘটনা হলেই রেলমন্ত্রকে কর্তা ব্যক্তিরা– মন্ত্রী থেকে আমলা, সবাই যেন নাকে উনিশ পিঁপে নস্যি দিয়ে একের পর এক বৈঠক করেন। তৈরি হয় বিশেষজ্ঞ কমিটি। কমিটি নানান দিক পর্যালোচনা করে কখনো বা আবার পরামর্শ দেয় সরকারকে। কিন্তু সেই পরামর্শ কতটা পালন করা হল আর কতটা অধরা থেকে গেল তা কেউ জানতে পারে না।
কাল দ্বিতীয় কিস্তি। নজর রাখুন।