খাস খবর ডিজিটাল ডেস্ক : কাজ ফুরোলেই পাজি? লাথি মারার জন্য কেন গরিবের পেটকেই এত পছন্দ? শাসকের কথায় বলে, কাজের সময় কাজি, কাজ ফুরোলেই পাজি!
বহুল ব্যবহারে জীর্ণ এই প্রবাদের আক্ষরিক অর্থটা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন বেহালার ঋতু মল্লিক, হাতিবাগানের নিতাই রক্ষিত কিংবা সল্টলেকের ওয়েবেলের সামনের ফুটপাত দখল করে থাকা সতীশ সাউরা।
এরা প্রত্যেকেই সংসারের একমাত্র রোজগেরে। ঋতুর চা, টোস্টের দোকান। নিতাই ফুটপাতে জামা কাপড় বিক্রি করতেন। ওয়েবেলের সামনে ফাস্টফুডের দোকান ছিল সতীশের।
ছিল। এখন আর নেই, মানে ‘অতীত’। সৌজন্যে, গত সোমবার নবান্নে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘গরম বৈঠক’ এবং তারপর থেকে কলকাতা শহরজুড়ে হকার উচ্ছেদে পুলিশি তৎপরতা।
ফুটপাত জবরদখল উচ্ছেদে ‘সরকারি প্রয়াস’ রাতারাতি অনিশ্চিত ভবিষ্যতের মুখে ঠেলে দিয়েছে ঋতু, নিতাই, সতীশ এবং তাঁদের পরিজনকে। পরিস্থিতি এতটাই ভয়াবহ, আগামী মাস থেকে ছেলের টিউশন ফিজ দিতে পারবেন কিনা জানেন না ঋতু।
মাঝবয়েসি বিধবা মহিলা বলছিলেন, স্বামী মারা যাওয়ার পর বাধ্য হয়ে দোকানে এসে বসেছিলাম। অনেক কষ্ট করেই দোকান থেকে দুবেলার পেটের ভাত জোগাড় হচ্ছিল। ভোটের সময় তৃণমূলের মিটিংয়ে যাওয়ার জন্য দু দু’বার দোকান বন্ধও রাখতে হয়েছিল।
আরও পড়ুন : মাদক ব্যবসার প্রতিবাদে আক্রান্ত তৃণমূল নেতা, কাঠগড়ায় বিজেপি
ঋতুর কথায়, “সেই নেতাদের এখন বলতে গেলে তাঁরা দুহাত তুলে দিয়েছেন। বলছেন, ‘আমাদেরই চাকরি (পড়ুন, পার্টির পদ) থাকবে কিনা জানি না! মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশ, কার ঘাড়ে দুটো মাথা আছে যে তাঁর উপরে কথা বলবেন’।”
নিতাইয়ের বাবা শয্যাশায়ী। পেটে ভাত জুটুক না জুটুক মাস ফুরোলে বাবার জন্য ৩০০০ টাকার ওষুধ কিনতে হয়। উচ্চ মাধ্যমিক পাশ নিতাই বলছিলেন, “চাকরি দেবার মুরোদ নেই সরকারের। খেটে খাচ্ছিলাম, সেটাও সহ্য হল না।” ক্ষণিক থেমে পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছেন, “আচ্ছা গরিবের পেট বলেই কি লাথি মারা এত সহজ?”
সতীশের অবস্থা আরও করুন। সে এই রাজ্যের বাসিন্দাই নয়। বড়দার সূত্রে দু’দশক আগে এই শহরে পা রেখেছিলেন। ওয়েবেলের সামনে রমরমিয়ে চলছিল তাঁর ফাস্টফুডের দোকান। রোজগারও মন্দ হচ্ছিল না। সম্প্রতি সাত পাকে বাঁধা পড়েছেন। বলছিলেন, “মঙ্গলবার থেকে রাতের ঘুম উড়ে গেছে। দু’চোখের পাতা বন্ধ করতে পারছি না। স্ত্রী গর্ভবতী, সামনে অনেক খরচ। জানি না কী করব!”
ঋতু, নিতাই, সতীশরা উদাহরণ মাত্র। কলকাতা থেকে জেলা, মঙ্গলবারের পর থেকে এমন হাজার হাজার হকার রাতারাতি কার্যত পথে বসেছেন। কান্নার রোল উঠেছে গরিবের ঘরে।
বিষয়টি নিয়ে সমাজে মিশ্র প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে। একাংশের মতে, “এটা হওয়ারই ছিল। এভাবে ফুটপাত দখল মেনে নেওয়া যায় না।” অপর অংশের মতে, “এতই যদি জবরদখল মুক্ত করার শখ তাহলে ভোটের আগে করলেন না কেন?
নিয়োগ দুর্নীতি, রেশন চুরি, সন্দেশখালি প্রসঙ্গ টেনে
নিন্দুকরা বলছেন, ‘আবর্জনা মুক্ত’ করতে হলে সবার আগে তো তৃণমূলের ভেতরের ‘জঞ্জাল মুক্ত: করা দরকার।
সোমবার নবান্নের প্রশাসনিক বৈঠক থেকে মুখ্যমন্ত্রী নিজেই অকপটে জানিয়েছেন, টাকার বিনিময়ে হকারদের রাস্তায় বসিয়েছেন পুরসভার একাংশ কাউন্সিলর, পুরকর্মী এবং পুলিশ। সরাসরি তোপ দেগেছেন সুজিত বসু, ফিরহাদ হাকিমদের। তাহলে সুজিত, ফিরহাদদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ না নিয়ে হকারদের বলির পাঁঠা কেন করা হচ্ছে, সেই প্রশ্ন তুলছে সংশ্লিষ্ট মহল।
বিরোধীদের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে জনমানসে। মঙ্গলবার থেকে হকার উচ্ছেদ শুরু হলেও ঘটনার ২৪ ঘণ্টা পর, বুধবার দুপুরের পর থেকে এ ব্যাপারে মিডিয়ার সামনে মুখ খুলতে শুরু করেছেন বিরোধী দলের নেতা,নেত্রীরা। অন্যদিকে পরিস্থিতি আঁচ করে বৃহস্পতিবার ফের নবান্নে বৈঠকে বসতে চলেছেন মুখ্যমন্ত্রী। যার প্রতিক্রিয়ায় বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী বুধবার সন্ধেই সাংবাদিক বৈঠক থেকে জানিয়েছেন, হকার উচ্ছেদের বিষয়ে সরকার সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা না করলে শুক্রবার থেকে পাল্টা প্রতিরোধ গড়ে তুলবেন তাঁরা। শুভেন্দুর কথায়, “প্রয়োজনে আমি নিজে বুলডোজারের সামনে গিয়ে দাঁড়াব।”
বিরোধীদের এই ‘গা ছাড়া মনোভাব’ প্রসঙ্গে একদা রাজ্যের বিরোধী দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রশংসা শোনা যাচ্ছে ওই নিন্দুকদের মুখেই। তাঁরা বলছেন, “একটা কথা মানতেই হবে, শুভেন্দুদের জায়গায় মমতা নিজে থাকলে সরকারকে এত সময় দিতেন না। মঙ্গলবার উচ্ছেদ শুরুর সময়ই তিনি ঘটনাস্থলে পৌঁছে আক্রান্তদের নিয়ে পাল্টা প্রতিরোধ গড়ে তুলতেন। তাতে অন্তত গরিব মানুষগুলোর পেটে এভাবে লাথি মারতে গেলে সরকারকে যথেষ্ট বেগ পেতে হতো!”
একথাও ঠিক, এই ধরনের ঘটনার ক্ষেত্রে দলের অন্যদের সঙ্গে আলোচনা না করেও তৎক্ষণাৎ সিদ্ধান্ত নেওয়ার ‘ফ্রি হ্যান্ড’ সুযোগ শুরু থেকেই রয়েছে মমতার। কারণ তিনি দলের সর্বময় কর্ত্রী। শুধুমাত্র এই কারণেই শুভেন্দুরা সবসময় অতীতের বিরোধী দলনেত্রীর ‘মেজাজে’র কাছে পিছিয়ে পড়ছেন কিনা, সেটা ভাল বলতে পারবেন পদ্মশিবিরের নেতা, নেত্রীরাই।
তবে রাজনীতির কচকচানির বাইরে গিয়ে একটা কথা বলাই যায়, সরকারের সিদ্ধান্তে হকারদের কাছে পূর্ণিমার চাঁদ এখন সত্যিই ঝলসানো রুটি!