অভিনব চট্টোপাধ্যায়: পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক সংস্কৃতি এখন কোন পথে? রাজনৈতিক দায়বদ্ধতা ও মূল্যবোধের এমন চরম অবক্ষয়, বাংলা এর আগে কি কখনও দেখেছে? ২০২১ এর বিধানসভা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের যে ধরনের ভাষণ চালাচালি হচ্ছে এবং কাজকর্মের নিদর্শন সামনে উঠে আসছে তার কতটা বিরূপ প্রতিক্রিয়া সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনে হতে পারে তা কেবল কষ্ট কল্পনামাত্র।
সাম্প্রতিককালে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় ও শুভেন্দু অধিকারীর মধ্যে যে মানের বাক্য বিনিময় হয়েছে, তা বাংলার রাজনৈতিক সংস্কৃতির ইতিহাসে নজিরবিহীন বললেও কম বলা হয়। রাজনীতির দুর্বৃত্তায়ন ভারতে নতুন কিছু নয়৷ কিন্তু গত ১০ বছরে আমাদের বাংলায় রাজনীতির যে চরম মৌলিক, সাংস্কৃতিক ও মূল্যবোধের বিপর্যয় ঘটেছে তা শুধু নজিরবিহীনই নয়, আমাদের লজ্জারও।
কয়লা, গরু, সোনা – পাচার থেকে শুরু করে টাকার বিনিময়ে চাকরি, চিটফান্ডের টাকা আত্মসাৎ- দুনিয়াদারির সব ধরণের কুকীর্তির প্যাকেজ ডিপ্লোমার শিরোপায় জড়িয়ে গিয়েছেন শীর্ষ স্থানীর রাজনৈতিক কর্তা-ব্যক্তিরা।
বাংলায় একটি প্রবাদ বাক্য আছে- মাছের পচন ধরে মুড়ো থেকে, লেজা থেকে নয়।
সামগ্রিক বাংলার সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ ও অপরাধমূলক কাজকর্ম করার প্রবণতা যে হারে বৃদ্ধি পেয়েছে তার দায় কি এড়িয়ে যেতে পারবেন রাজনৈতিক নেতারা? কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণে টুম্পা সোনার গানে কোনও অশ্লীলতা থাকলে তার দায় কার? এই সাংস্কৃতিক অবক্ষয়ের জন্য নিজেদের দায় কি ঝেড়ে ফেলতে পারবেন তথাকথিত সমাজসেবীরা? কয়লা ও গরু পাচারের মধ্যে রাজনৈতিক নেতারা জড়িয়ে গেলেন কী করে? ইন্ধন জোগালেন কারা? প্রয়োজনই বা হল কেন?এর উত্তর কিন্তু অনেক গভীরে।
এর উত্তরের দিকে যাওয়ার আগে আমাদের দেখা প্রয়োজন আরেকটি ঘটনা। সম্প্রতি খবরের শিরোনামে এসেছেন পামেলা গোস্বামী। কে এই পামেলা? কী করে তিনি বিজেপির মতো একটা রেজিমেন্টেড পার্টির এত উচ্চপদে আসীন হলেন? তার তো কোনও রাজনৈতিক ইতিহাস নেই, তাহলে কি লিফটের চেয়েও দ্রুতগামী কোনও শক্তি আছে, যার জোরে তিনি এত উচ্চপদে আসীন হতে পারেন।
বিজেপির শীর্ষস্থানীয় নেতারাও বা কোন যাদুবলে এই ধরনের ব্যক্তিত্বকে এত দায়িত্বশীল পদে বসান বা বসাতে বাধ্য হন। এই সব ঘটনার দলীয় অন্তর্তদন্ত না হলে রাজনীতির শুদ্ধিকরণ সম্ভব নয়।
রাজনৈতিক দল পরিচালনা করার জন্য টাকার দরকার হয়। নেতাদের নিজেদের কর্মকাণ্ড চালানোর জন্য টাকার দরকার হয়। এই দুইয়ের ক্ষেত্রে যদি টাকা দরকার হয় তাহলে সে টাকার যোগান আসবে কোথা থেকে? এর সমাধান আপাতদৃষ্টিতে তিনটি। প্রথমত, দরকার Electoral Reforms। দ্বিতীয়ত, রাজনৈতিক দল পরিচালনার পদ্ধতিগত পরিবর্তন। তৃতীয়ত, প্রকৃত শিক্ষিত এবং দীক্ষিত ব্যক্তিবর্গের হাতে রাজনৈতিক ক্ষমতা কুক্ষিগত হওয়া দরকার।
পশ্চিমবাংলার রাজনৈতিক অবক্ষয় যদি বাস্তবিকই রুখতে হয় তাহলে শুধু পালাবদল হলেই সমস্যার সমাধান হবে না। প্রয়োজন রাজনৈতিক কর্তৃত্বের খোলনলচে বদল৷ যদি পরিবর্তন বাস্তবায়িত হয় তাহলেও কী ধরনের নেতৃত্বের হাতে ক্ষমতা গিয়ে পড়বে তা কিন্তু হতে চলেছে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ আলোচ্য বিষয়। যদি পরিবর্তন নাও হয় সেক্ষেত্রে রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও দুর্বৃত্তায়নের বিরুদ্ধে গিয়ে দলের খোলনলচে পালটানোর উদ্যোগ নেওয়াটা সবচেয়ে জরুরি।
আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনে ধরে নেওয়া যেতে পারে মূল লড়াই হতে চলেছে তৃণমূল ও বিজেপির মধ্যে। সেক্ষেত্রে সমগ্র রাজনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের দায়িত্ব কিন্তু বর্তাচ্ছে এই দুই দলের ওপরে। যদি ধরে নেওয়া যায় যে বামপন্থীরা আসন্ন নির্বাচনে তৃতীয় স্থানে থাকবেন কিন্তু সমাজ সংস্কারে একটি ক্ষমতাবান Pressure Group হিসাবে তাঁদের অবস্থান খুবই গুরুত্বপূর্ণ হবে। সব দলকেই মনে রাখতে হবে যদি প্রকৃতই বাংলার উন্নয়ন ঘটাতে হয় তাহলে সাংস্কৃতিক ও মূল্যবোধের উন্নয়ন ঘটাতে হবে সবার আগে। ভালো মানুষ ছাড়া ভালো সমাজ গঠিত হতে পারে না- এটাই প্রথম ও শেষ কথা।