সুমন বটব্যাল, কলকাতা: আত্মনির্ভর ভারতের কথা বলা হচ্ছে? বাঙালি পিছিয়ে কেন বলা হচ্ছে? ডা: সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের নাম ক’জন জানেন?
বেঙ্গল ক্লাবে তখন পিন পড়ার নিস্তব্ধতা! উত্তরটা দিলেন নিজেই, ‘‘আজ আমরা যে টেস্ট টিউব বেবির জন্ম দিচ্ছি, উনি তার সৃষ্টিকর্তা! সেটা ১৯৭৮ সালের ২৫ জুলাই৷ টেস্টটিউব বেবির জন্ম৷ মাত্র ৬৭ দিন বাদে ৩ অক্টোবর, কানোপ্রিয়া অগ্রওয়াল বা দুর্গার জন্ম হল৷’’
অম্লান আত্মীয় সমাজের সহযোগিতায় ‘একুশ শতকে বাংলার নবজাগরণ’ বিষয়ক আলোচনাসভার আয়োজন করেছিল খাস খবর৷ বক্তাদের তালিকায় ছিলেন টেস্ট টিউব বিশেষজ্ঞ ডা: গৌতম খাস্তগির৷ খানিক থেমে তাঁর সংযোজন, ‘‘সরাসরি পেট কেটে ডিম্বানু সংগ্রহের পরিবর্তে প্রসবের পথ দিয়ে তা সংগ্রহের করার পদ্ধতি প্রথম দেখিয়েছিলেন সুভাষবাবুই৷
উনিই বলেছিলেন- ওষুধের মাধ্যমে ডিম্বানুর সংখ্যা বাড়ালে সাফল্য বাড়বে এবং ডিম্বানুটি সংগ্রহ করে শুক্রানুর সঙ্গে নিষেক ঘটিয়ে পরে ভ্রুনটিকে প্রতিস্থাপিত করলে সাফল্য বেশি পাওয়া যায়৷ আজ সারা বিশ্ব সেটাই ফলো করছে৷ অথচ মানুষটা যোগ্য সম্মান পেল না, হেনস্থা হতে হল৷ বাধ্য হলেন ১৯৮১ সালে আত্মহত্যা করতে৷ সুইসাইড নোটে লেখা ছিল- আই ক্যান্ট ওয়েট ফর অ্যা হাটঅ্যাটাক টু কিল অর টেক মি অ্যাওয়ে।’’
টেস্ট টিউব বেবির সৃষ্টিকর্তা সুভাষ মুখোপাধ্যায় সম্পর্কে দুটি বইও লিখেছেন ডা: খাস্তগির- মরণোত্তর মুকুট, টু বিউটিফুল মাইন্ড৷ সেই প্রসঙ্গেই ডা: খাস্তগির বলেন, ‘‘একজন চিকিৎসক হিসেবে এত বড় অন্যায় ও অবিচার আমি আজও মেনে নিতে পারিনি৷ আমার জীবনের একটাই উদ্দেশ্যে, মৃত্যুর আগে যদি দেখে যেতে পারি ভদ্রলোক স্বীকৃতি পেয়েছেন তাহলে আমার জীবন হয়তো সার্থক হবে৷’’
কে এই সুভাষ মুখোপাধ্যায়? গৌতমবাবু জানান, রাজাবাজার সায়েন্স কলেজের মেধাবী এই পড়ুয়া ছিলেন ইউনিভার্সিটি অব এডিনবোরাতে৷ দেশের টানে ছুটে এসেছিলেন পৈত্রিক ভিটেয়৷ কিন্তু অপমান ছাড়া কি পেলেন? খানিক থেমে জবাবটাও দিলেন নিজেই, ‘‘সেটা ১৯৯৭ সাল৷ কলকাতায় সায়েন্স কংগ্রেসে যোগ এসেছেন টি সি আনন্দকুমার৷
প্রথম টেস্ট টিউব বেবির সৃষ্টিকর্তা হিসেবে তাঁকে সকলে জানেন৷ আমরা তাঁর হাতে সুভাষবাবুর থিওরিগুলো দিলাম৷ পড়ার পড় উনি নিজের পুরষ্কারের মুকুটটা খুলে দিয়েছিলেন৷ বলেছিলেন-যোগ্য লোক সম্মান পেল না৷ আমার ‘মরণোত্তর মুকুটে’ এই নিয়ে বিস্তারিত লেখা আছে৷’’
নাগাড়ে বলেই চলেছেন, অনেকটা যেন নিজেকেই নিজে কৈফিয়ত দেওয়া৷ বলছেন, ‘‘স্বামী-স্ত্রী দু’জনেই সারাটা জীবন গবেষণার জন্য ব্যয় করে দিলেন৷ সন্তান পর্যন্ত নিলেন না৷ বাড়িটাকেও আস্ত গবেষণাগার বানিয়ে ফেলেছিলেন৷ আর এমন মানুষকে আমরা নুন্যতম মর্যাদাও দিলাম না৷’’ কথার ফাঁকে ফাঁকে মনে করিয়ে দিয়েছেন বাঙালি কাঁকড়ার জাত, রবি ঠাকুরের কবিতা আওড়ে বলেছেন, ‘‘রেখেছো বাঙালি করে মানুষ করোনি৷’’
বিশ্বের সেরা চিকিৎসা জার্নালে দেশের যে তিনজন চিকিঞসকের নাম ঠাঁই পেয়েছে, সুভাষবাবু তাঁদেরই অন্যতম- এই তথ্য জানিয়ে ব্যাখ্যা দিয়েছেন, কেন মেধাবী বাঙালিরা দেশে ফিরতে চান না৷ তুলে ধরেছেন নিজের সম সাময়িক তিন কৃতী চিকিৎসক আশুতোষ হালদার, শিলাজিত্য ভট্টাচার্য, প্রকর দাশগুপ্তদের কথা৷ যোগ করেছেন, ‘‘নব জাগরণ ঘটছে৷ বাঙালির প্রতিভাও আছে৷ কিন্তু বাঙালি আসলে অন্ধ৷ দেখেও দেখতে চাই না৷’’
নিজের জীবন বৃতান্ত বলতে গিয়ে ঝরে পড়েছে আক্ষেপ, ‘‘অন্য প্রদেশের মানুষেরা বলেন- তোমরা তো নিজেদেরকেই সম্মান করো না, অন্যরা তোমাদের সম্মান করবেন কেন? সত্যি তো তাই? আজ যারা রাত দিন এক করে মানুষের সেবায় নিয়োজিত তাঁরা কি যোগ্য সম্মান পাচ্ছেন?’’ খানিক থেমে যোগ করেছেন, ‘‘৮-১০ বছর পরে যখন আমি একটি বিত্তবান হলাম তখন মানুষ আমার কাছে আসে ডোনেশনের জন্য৷ অথচ তার আগে কেউ পাত্তাও দেইনি৷ বিনা পয়সায় পড়াতে গেলেও আমাকে বহু জায়গায় সুযোগ দেওয়া হয়নি৷’’
দুঃখ করে বলেছেন, ‘‘বহু রোগীর ও তাদের পরিজনদের ভালবাসা পাই৷ কিন্তু অ্যাওয়াার্ডের দিনগুলোর পরের ৭দিন চেম্বারে যেতে পারি না৷ গেলেই সবাই জিজ্ঞাসা করে, আপনি এবারেও অ্যাওয়ার্ড পাননি৷ অ্যাওয়ার্ড কি দরকার, মানুষের ভালবাসাই তো অনেক৷ কিন্তু ওঁদের বোঝায় কি করে!’’
তবে অবিচারের চাকা ঘুরবে, সুবিচার মিলবে- আশাবাদী ডা: খাস্তগির৷ বলছেন, ‘‘স্বপ্ন দেখতে দোষ কোথায়? আমি আশাবাদী বাঙালি বদলাবে৷’’ সেই সুরটাকেই আরও ভাল করে বেঁধে দিলেন অনুষ্ঠানের দুই সঞ্চালক অভিনব চট্টোপাধ্যায় ও রুথলিন সাহা নাথ বললেন, ‘‘সাম্প্রতিক অতীতে সত্যি দু’জন বাঙালির প্রতি অবিচার হয়েছে৷
এক, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, দুই জ্যোতি বসু৷ আশা রাখি, আমরা আগামীদিনে একই ভুলের পুনরাবৃত্তি ঘটাব না৷’’ আলোচনায় অংশ নেন অধ্যাপিকা মিরাতুন নাহার, ড: অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায়, চান্দ্রেয়ী আলম, ড: পারুল মণ্ডল (সিং), শিল্পী অরুণ কুমার চক্রবর্তী, অধ্যাপক জ্যোতির্ময় গোস্বামী ও বিশিষ্ট সাংবাদিক রন্তিদেব সেনগুপ্ত৷