‘বঙ্গবন্ধু’র পূর্ব-পশ্চিম

0
313

সিদ্ধার্থ মজুমদার, কলকাতা: ‘অন বিহাফ অব আওয়ার বিলাভেড লিডার শেখ মুজিবর রহমান, আই জেনারেল জিয়াউর রহমান, ডিক্লেয়ার দ্য ইন্ডিপেনডেন্স অব বাংলা দেশ’। এই ঘোষণাখানি কলকাতার স্বাধীন বাংলা দেশ বেতার কেন্দ্র থেকে সম্প্রচারিত হওয়া মাত্র বিদ্রোহের আগুন ছড়িয়ে পরে বাংলা দেশে। আর সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় ‘৭১এর মুক্তিযুদ্ধ। কলকাতা থেকে যে শুধুই বাংলা দেশের স্বাধীনতার ঘোষণা পত্র পড়া হয়েছিল তাই নয়, এছাড়াও এই মুক্তিযুদ্ধের প্রাণপুরুষ মুজিবুর রহমানের সঙ্গেও কিন্তু কলকাতার একটা আত্মিক যোগ আছে।

মুজিবুর রহমানের প্রথম কলকাতায় আসা, ১৯৩৯ সালে। তবে সেবার তিনি এসেছিলেন বেড়াতে, কিন্তু উল্লেখ্য যে, তার আগেই কিন্তু রাজনীতিতে হাতে খড়ি হয়ে গেছে তাঁর। ওপার বাংলার গোপাল গঞ্জে তখন তিনি মুসলিম ছাত্র লীগ গঠনের কথাও ভাবছেন। তরুন মুজিব কলকাতায় এসে দেখাও করেন, মুসলিম লীগের নেতা হোসেন শহিদ সোহরাওর্দির সঙ্গে।

- Advertisement -

এরপর কলকাতায় আসেন ১৯৪১ সালে। তখন অবশ্য পড়াশোনা করতে আসা। ম্যাট্রিক পাশ করে কলকাতায় এসে ভর্তি হন ইসলামিয়া কলেজে, যার এখন নাম, মৌলানা আজাদ কলেজ। পড়াশোনা করতেন আইন বিভাগে। থাকার ব্যবস্থা হল কলকাতার ‘বেকার হোস্টেল’এ। তিন তলার ২৩,২৪ নম্বরের ঘর দুটি নিয়ে থাকতেন মুজিব। রাজনীতির স্ফুরণ এখানেও দেখা গেল, যখন জড়িয়ে পড়লেন ছাত্র রাজনীতিতে। এরপর ১৯৪৫-১৯৪৬ সালে ইসলামিয়া কলেজের ছাত্র সংগঠনের সম্পাদকও হয়েছিলেন তিনি। তাই আজও যদি কেউ মৌলানা আজাদ কলেজে যাও তাহলে দেখতে পাবে সেই কলেজের ছাত্র সম্পাদকের নামের তালিকায় এখনও লেখা আছে মুজিবের নাম, দুটো শব্দ, ‘এম.রহমান’।

এরপর এল সেই কালো দিন, ১৯৪৬ সালের ১৬ই আগস্ট। মুসলিম লীগ আর কংগ্রেসের মধ্য তখন দারুন অমত। মুসলিম লীগ দাবী জানালো তাদের পাকিস্তান চাই, প্রথমে ছিল মতের লড়াই এরপর হঠাৎই শুরু হল খুনোখুনি। প্রথমে কলকাতায় তারপরে নোয়াখালীতে ছড়িয়ে পড়ল ক্ষোভ, শুরু হল ‘৪৬এর ভয়ঙ্কর দাঙ্গা। বহু নরবলির পর ভাগ হয়ে গেল ভারত আর পাকিস্তান, সৃষ্টি হল, তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের।

এই নরবলি দেখে অত্যন্ত দুঃখ পেয়েছিলেন মুজিব। নাহ, এটা আমাকে কেউ বলেনি, কিন্তু আমি জানি। কেন জানেন? কারণ এই মুজিব যথেষ্ট বিচলিত হয়েছিলেন ‘৪৩এর দুর্ভিক্ষের সময় মানুষের কষ্ট দেখে। নিজের কলেজের ছাত্রদের নিয়ে ছুটে ছুটে গেছেন মানুষকে সাহায্য করতে। তাঁর নিজের লেখনীতে ছাপ ফেলে গেছে মানুষের পীড়ন। তিনি লিখছেন, “দুর্ভিক্ষ শুরু হয়েছে। গ্রাম থেকে লাখ লাখ লোক শহরের দিকে ছুটছে স্ত্রী-পুত্রের হাত ধরে। খাবার নাই, কাপড় নাই। ইংরেজ যুদ্ধের জন্য সমস্ত নৌকা বাজেয়াপ্ত করে নিয়েছে। ধান, চাল সৈন্যদের খাওয়াবার জন্য গুদাম জব্দ করেছে।”  মানুষকে সামান্য ফ্যানের জন্যে হাহাকার করতে দেখে তিনি আবার ছুটে গেলেন সোহরাওর্দির কাছে। তাঁর সাহায্যে এবং মুজিবের পরিশ্রমে গরে উঠলো এক, ‘সিভিল সাপ্লাই ডিপার্টমেন্ট’। তারপর এদের প্রচেষ্টায় গ্রামে গ্রামে গড়ে উঠলো লঙ্গরখানা। তিনি এও লিখেছিলেন যে, “যুদ্ধ করে ইংরেজ, আর না খেয়ে মরে বাঙালি; যে বাঙালির কোনো কিছুরই অভাব ছিল না।”

তাই দেশভাগের পর বাংলা দেশে ফিরে গেলেও তিনি কলকাতাকে ভুলতে পারেননি। তাই মুক্তিযুদ্ধের সময় নিজের বার্তা যখন মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে যখন দরকার হল নিজেদের বেতারকেন্দ্রের, তখন পূর্ব পাকিস্তানে সেই কেন্দ্র স্থাপন করা সম্ভব ছিলো না, তাই তিনি আবার ফিরলেন কলকাতার দিকে। এখানেই স্থাপিত হল স্বাধীন বাংলা দেশ বেতার কেন্দ্র আর সেখান থেকেই পাঠ হল স্বাধীনতার ঘোষণা পত্র।

তাই আজ মুজিবের শততম জন্মদিনে দাঁড়িয়ে আমার অন্তত মনে হয় কলকাতার সঙ্গে মুজিবের যোগটা অনেকটাই আত্মিক। সেই সুমনের গানে ছিল না, ‘এই শহর জানে আমার প্রথম সব কিছু’, মুজিবের রাজনৈতিক ক্ষেত্রে পদার্পণের প্রায় অনেকটাই জানে এই শহর। হয়ত আজও বেকার হোস্টেলের তিন তলার ঘর থেকে বাইরে তাকিয়ে থাকে সুদূর বিস্তৃত দুটো চোখ। সে দৃষ্টিতে মায়া আছে, ছায়া আছে মানুষের আর আছে দৃঢ় সংকল্প। হয়ত সেই কারণেই তাঁকে বঙ্গবন্ধু বলা হয়। হয়ত এই বন্ধুত্বের রেশ এখনও বাকি আছে দুই বাংলায়। হয়ত তা কোন দিন ক্ষতবিক্ষত হবে না সিমান্তের তারের কাঁটায়, হয়ত ‘নো ম্যান’স ল্যান্ড’এ এখনও আছে বন্ধুত্বের বসতবাড়ি।