ভারতীয় রেলকে বলা হয় ভারতবর্ষের লাইফ লাইন। কিন্তু সেই লাইফ লাইন-ই বর্তমান সময়ে হয়ে উঠেছে মানুষের জীবনের অন্যতম বড় ঝুঁকি। মন্ত্রী আসে মন্ত্রী যায়। সেইসঙ্গে নিত্যনতুন প্রতিশ্রুতি। বন্দে ভারত, বুলেট ইত্যাদি একের পর এক নয়া ট্রেনের ঘোষণা। কিন্তু এদিকে রেল পরিষেবায় যে কিছুমাত্র উন্নতি ঘটেনি, বরং পরিষেবার মান আরও নেমে গিয়েছে তা সম্প্রতি কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেস দুর্ঘটনাতেই জলের মত পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে। এই একটি দুর্ঘটনাই হাটের মাঝখানে হাঁড়ি ভেঙ্গে রেল পরিষেবার নগ্ন চিত্রটা তুলে ধরেছে দেশের জনগণের সামনে। আর এখানেই উঠে আসছে পৃথক রেল বাজেট (Rail Budget) নিয়ে মহাগুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটা। বিশেষজ্ঞ থেকে সাধারণ মানুষ, সকলেরই এখন প্রশ্ন, পরপর এতগুলি রেল দুর্ঘটনা- তারপরেও কেন আবার আগের মত পৃথকভাবে রেল বাজেট পেশ হচ্ছে না?
আরও পড়ুনঃ অথঃ কবচ উবাচ: খায় না মাথায় দেয়
২০১৬ সালে শেষবারের মত পৃথকভাবে পেশ করা হয়েছিল রেল বাজেট (Rail Budget)। এরপর ২০১৭ থেকে রেল বাজেট (Rail Budget) এবং সাধারণ বাজেট একীভূতকরণ করা হয়। গত বছরের কেন্দ্রীয় বাজেটে রেলের জন্য বরাদ্দ করা হয়েছিল ২.৪ লক্ষ কোটি টাকা। কিন্তু রেলমন্ত্রী অশ্বিনী বৈষ্ণব এ প্রসঙ্গে জানান, এই টাকা ‘বন্দেভারত’ প্রকল্পে ব্যবহৃত হবে। ফলে তখনই প্রশ্ন উঠছিল, রেলের সামগ্রিক পরিষেবাকে বাদ দিয়ে কেন শুধুমাত্র ‘বন্দেভারতে’র উপরেই বাড়তি জোর দেওয়া হচ্ছে? সম্প্রতি কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেস দুর্ঘটনাতে এই প্রশ্ন যে এক বাড়তি মাত্রা লাভ করেছে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। দুর্ঘটনার ফলে নতুন করে আবার প্রশ্নের মুখে পড়েছে রেল পরিকল্পনা নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের ভূমিকা। সে প্রসঙ্গে বিস্তারিত যাওয়ার আগে জেনে নেওয়া যাক রেল বাজেট সম্পর্কে।
কবে থেকে শুরু হয়েছিল পৃথক রেল বাজেট?
বর্তমানের মত ১৯২৪ সালের আগেও রেল বাজেট (Rail Budget) বলে আলাদা করে কিছু ছিল না। সাধারণ বাজেটের মধ্যেই একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ করা থাকত রেলের জন্য। ১৯২০-২১ সালে ব্রিটিশ রেলওয়ে অর্থনীতিবিদ উইলিয়াম অ্যাকওয়ার্থের নেতৃত্বাধীন ‘অ্যাকওয়ার্থ কমিটি’ কর্তৃক প্রদত্ত ‘অ্যাকওয়ার্থ রিপোর্ট’ -এর ভিত্তিতে ১৯২৪ সালে প্রথমবার রেলের অর্থকে সাধারণ বাজেট থেকে পৃথক করা হয়। এরপর ১৯২৪ সালে সর্বপ্রথম পৃথকভাবে রেল বাজেট ঘোষণা করা হয়েছিল। যে ধারা ২০১৬ পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। অর্থাৎ টানা ৯২ বছর। এর মধ্যে স্বাধীন ভারতের প্রথম রেলমন্ত্রী জন মাথাই ১৯৪৭ সালের ২০ নভেম্বর স্বাধীন ভারতের সর্বপ্রথম রেলওয়ে বাজেট পেশ করেছিলেন। তবে সেটি ছিল অন্তর্বর্তী রেল বাজেট। মাসতিনেক পর ১৯৪৮ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি তিনি তাঁর দ্বিতীয় রেল বাজেট পেশ করেন।
ঠিক কী কারণে তুলে দেওয়া হল পৃথক রেল বাজেট?
কেন্দ্রীয় বাজেট ঘোষণার দিনকয়েক আগে পৃথকভাবে রেল বাজেট (Rail Budget) পেশ, ২০১৬ সাল পর্যন্ত এটাই ছিল রীতি। যা টানা ৯২ বছর ধরে চলে এসেছে। ২০১৬ সালের ২১ সেপ্টেম্বর তারিখে মোদি সরকার এই রীতিতে ছেদ টেনে ২০১৭ থেকে রেল বাজেট এবং সাধারণ বাজেট একীভূতকরণের অনুমোদন দেয়। কিন্তু ঠিক কী কারণে এমনটা করা হল, সে বিষয়ে স্পষ্ট করে কোনও যুক্তি দেওয়া হয়নি কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে। সময় বাঁচাতেই রেল বাজেটকে কেন্দ্রীয় বাজেটের সঙ্গে একীভূত করা হয়েছিল, এমন যুক্তি দিয়েছিল রেল। এছাড়া ২০১৬ সালে পৃথক রেল বাজেট তুলে দেওয়ার সময় তৎকালীন রেলমন্ত্রী সুরেশ প্রভু যুক্তি দিয়েছিলেন, ‘এই একীভূতকরণটি শুধু রেলওয়ের জন্য নয়, সেইসঙ্গে দেশের অর্থনীতির দীর্ঘমেয়াদী স্বার্থের জন্যও জরুরী ছিল। তাছড়া এটি একটি ঔপনিবেশিক প্রথা ছিল, যা শেষ করা প্রয়োজন।’
পৃথক রেল বাজেটের ত্রুটি
পৃথক রেল বাজেট (Rail Budget) তুলে দেওয়া নিয়ে বিরোধীদের প্রশ্ন তোলা স্বাভাবিক। কিন্তু শুধু বিরোধীরাই নন, রেল বাজেটকে কেন্দ্রীয় বাজেটের সঙ্গে একীভূত করার পর থেকে প্রশ্ন তুলতে শুরু করেন অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞরাও। তাঁদের বক্তব্য, রেল একটি পুরোপুরি আলাদা ক্ষেত্র। দেশের সিংহভাগ মানুষ-ই যোগাযোগের জন্য রেলের উপর নির্ভরশীল। তাই রেলের পরিষেবা এবং নিরাপত্তায় বাড়তি গুরুত্ব দেওয়া জরুরি। অন্যদিকে বিরোধীদের দাবী, এর আগে যখন পৃথক রেল বাজেট (Rail Budget) ছিল তখন কোন খাতে কত বরাদ্দ করা হচ্ছে, সে বিষয়ে স্পষ্ট একটা ধারণা পাওয়া যেত। কিন্তু এখন পৃথক রেল বাজেট উঠে যাওয়ায় কিছু বোঝার উপায় নেই। একই কথা বলছেন অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞরাও।
পরপর দুর্ঘটনা টলিয়ে দিয়েছে রেল মন্ত্রকের আসন। তাই একপ্রকার বাধ্য হয়েই একটি বিবৃতিতে তারা জানাচ্ছে যে গত ১০ বছরে রেল দুর্ঘটনার সংখ্যা ৬০ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। এদিকে তথ্য বলছে, গত ৬২ বছরে রেল দুর্ঘটনার সংখ্যা ৩৮ হাজারেরও বেশি। এর মধ্যে ২০১৬ সালে রেল বাজেট উঠে যাওয়ার বছর থেকে এখনও পর্যন্ত রেল দুর্ঘটনার সংখ্যা ৫২টি। কিন্তু তা নিয়ে যে রেলের বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা নেই তা প্রমাণ করে দিচ্ছে একের পর রেল দুর্ঘটনা-ই। রেলের মাথাব্যথা শুধু ‘বন্দেভারত’ বা ‘বুলেট’ নিয়েই। সাধারণ মানুষের জীবন নিয়ে ভাবার কেউ নেই।
কাল তৃতীয় কিস্তি। নজর রাখুন।